দুর্গা পূজা:
বাঙালির উৎসবের হৃদয়স্পর্শী গল্প
দুর্গা পূজা
বাঙালির জীবনে শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি আবেগ, একটি
সংস্কৃতির উৎসব, যা প্রতিটি
বাঙালির হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত। প্রতি বছর শরৎকালে, যখন কাশফুলের সাদা মেঘ ভাসে আর শিউলির গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে,
তখন বাঙালি মন উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে। মা দুর্গার
আগমনের প্রতীক্ষায় কলকাতার রাস্তাঘাট, পাড়া-মহল্লা
জেগে ওঠে এক অপূর্ব উৎসাহে। এই নিবন্ধে আমরা দুর্গা পূজার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, এবং এর সামাজিক গুরুত্ব কী ? আসুন ছোট্টো করে
জানি ।
দুর্গা পূজার
ঐতিহাসিক পটভূমি
দুর্গা পূজার
উৎপত্তি নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। ঐতিহাসিকভাবে, এই উৎসবের শিকড় মধ্যযুগীয় বাংলায় পাওয়া যায়। ১৬০৬ সালে নদিয়ায়
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দের তত্ত্বাবধানে প্রথম দুর্গা পূজার
উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে, ব্রিটিশ
শাসনামলে দুর্গা পূজা একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে নতুন মাত্রা পায়।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে নবকিষাণ দেবের সৌভাগ্যপূর্ণ
দুর্গা পূজার কাহিনীও প্রচলিত। এই সময়ে জমিদার ও বণিক শ্রেণির মাধ্যমে দুর্গা
পূজা একটি প্রদর্শনীমূলক উৎসব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
দুর্গা পূজার
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
দুর্গা পূজা
মূলত দেবী দুর্গার পূজা, যিনি
মহিষাসুরমর্দিনী হিসেবে অশুভ শক্তির বিনাশকারী। শাস্ত্র অনুসারে, মা দুর্গা তাঁর চার সন্তান—কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী
ও লক্ষ্মী—সহ কৈলাস থেকে তাঁর পিতৃভবনে আগমন করেন। এই পূজা বাঙালির কাছে একটি
পারিবারিক উৎসব, যেখানে মায়ের
আগমন পিতৃভূমিতে পুনর্মিলনের প্রতীক। মহালয়ার দিনে ‘চক্ষুদান’ বা মূর্তির চোখ
আঁকার মাধ্যমে দেবীকে জাগ্রত করা হয়, এবং
দশমীর দিনে বিসর্জনের মাধ্যমে তাঁকে বিদায় দেওয়া হয়।
সাংস্কৃতিকভাবে,
দুর্গা পূজা বাঙালির শিল্পকলা, সঙ্গীত, নৃত্য
ও সাহিত্যের একটি মহাসম্মিলন। কলকাতার কুমারটুলির কারিগররা মাটির মূর্তিতে প্রাণ
প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বের
বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি হয়। প্যান্ডেলের সজ্জা, ধুনুচি নাচ, ধাকের
তাল, এবং শাঁখের ধ্বনি এই উৎসবের
অপরিহার্য অঙ্গ।
পূজার প্রধান
দিনগুলি
দুর্গা পূজা
মূলত পাঁচ দিনের উৎসব—ষষ্ঠী, সপ্তমী,
অষ্টমী, নবমী
এবং দশমী।
- মহালয়া: এই দিনে মহিষাসুরমর্দিনী
সম্প্রচারের মাধ্যমে পূজার সূচনা হয়। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে এই
অনুষ্ঠান বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী।
- ষষ্ঠী: এই দিনে দেবীর বোধন হয়,
যা তাঁর
আগমনের আনুষ্ঠানিক সূচনা।
- সপ্তমী: নবপত্রিকা বা কলাবউয়ের পূজার
মাধ্যমে সপ্তমীর পূজা শুরু হয়।
- অষ্টমী: এটি পূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
দিন। পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধিপূজা
এবং কুমারী পূজা এই দিনের প্রধান আকর্ষণ।
- নবমী: এই দিনে দেবীর পূজা ও ভোগ
নিবেদন করা হয়।
- দশমী: বিসর্জনের দিন, যখন মা দুর্গার মূর্তি নদীতে
বিসর্জন দেওয়া হয়। সিন্দুর খেলা এবং ‘আসছে বছর আবার হবে’ বলে মায়ের
বিদায়ের আবেগময় মুহূর্ত এই দিনের বিশেষত্ব।
খাবারের উৎসব
দুর্গা পূজা
বাঙালির খাদ্যরসিকতারও একটি উৎসব। ভোগে থাকে খিচুড়ি, লাবড়া, আলুর দম,
পাঁপড়, টমেটোর
চাটনি এবং রসগোল্লা। এছাড়া রাস্তার ধারে ফুচকা, মাছের ফ্রাই, মুগলাই
পরোটা এবং ইলিশ মাছের ঝোলের মতো খাবার পূজার আমেজকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
সমাজে দুর্গা
পূজার প্রভাব
দুর্গা পূজা
শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঘটনা। কলকাতায় প্রায় ৩০০০টি বড়োবাড়ি পূজা এবং সর্বজনীন
পূজা আয়োজিত হয়, যা ২০১৯ সালে
পশ্চিমবঙ্গের জিডিপির ২.৫৮% অবদান রেখেছিল। এই উৎসব প্রায় তিন লক্ষ মানুষের জন্য
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
২০২১ সালে
কলকাতার দুর্গা পূজা ইউনেস্কোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ তালিকায় স্থান
পায়, যা এর সর্বজনীন আবেদন ও শিল্পকলার
মূল্যকে তুলে ধরে।
উপসংহার
দুর্গা পূজা
বাঙালির জন্য একটি জীবন উৎসব। এটি শুধু দেবী পূজার মাধ্যমে ধর্মীয় ভক্তি নয়,
বরং সম্প্রদায়ের একতা, শিল্পের প্রকাশ এবং জীবনের উৎসবমুখরতার প্রতীক। প্রতি বছর মা দুর্গার
বিদায়ের সময় বাঙালি বলে ওঠে, “আসছে
বছর আবার হবে”। এই আশায় বাঙালির হৃদয় আবারও নতুন উৎসাহে পূর্ণ হয়।
শুভ দুর্গা
পূজা! মা দুর্গার আশীর্বাদে সকলের জীবন সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক।


Hi Today gk guide Viewer please, Do Not Spam In Comments