বাঙালির ঐতিহ্যের গল্প দুর্গা পূজার কিভাবে সূচনা হয়েছিল ধর্মীয় এই মহাউৎসব

0

 

দুর্গা পূজার ইতিহাস: বাঙালির ঐতিহ্যের গল্প

দুর্গা পূজা বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উৎসব শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের একটি প্রতীক। দুর্গা পূজার ইতিহাস গভীর ও বহুমাত্রিক, যা প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনী থেকে আধুনিক কালের সর্বজনীন উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা দুর্গা পূজার ঐতিহাসিক পটভূমি ও এর বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করব।



পৌরাণিক উৎপত্তি

দুর্গা পূজার শিকড় পৌরাণিক কাহিনীতে পাওয়া যায়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, মা দুর্গা অসুর মহিষাসুরের বিরুদ্ধে দেবতাদের যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। মহিষাসুর ছিল এক শক্তিশালী অসুর, যাকে কোনো পুরুষ পরাজিত করতে পারত না। তাই দেবতারা মিলিতভাবে তাঁদের শক্তি একত্রিত করে দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করেন। দশ দিনের যুদ্ধের পর দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন, যা দশমীর দিনে উদযাপিত হয়। এই কাহিনী ‘দেবী মাহাত্ম্য’ বা ‘চণ্ডী’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে, যা মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ।

পৌরাণিকভাবে, দুর্গা পূজা শরৎকালে পালিত হলেও বসন্তকালে ‘বাসন্তী পূজা’ হিসেবেও পালিত হত। তবে, শরৎকালীন দুর্গা পূজা বা ‘অকালবোধন’ বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অকালবোধনের কাহিনী রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত। শ্রীরামচন্দ্র রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন, যা ঋতুচক্রের বাইরে অকালে বোধন হিসেবে পরিচিত। এই ঘটনা দুর্গা পূজার শরৎকালীন প্রচলনের সূচনা করে।





মধ্যযুগে দুর্গা পূজা

দুর্গা পূজার ঐতিহাসিক রূপ মধ্যযুগীয় বাংলায় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৬শ শতাব্দীতে নদিয়ার জমিদার ভবানন্দ মজুমদারের তত্ত্বাবধানে প্রথম সংগঠিত দুর্গা পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সময়ে পূজা মূলত জমিদার ও রাজপরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জমিদাররা তাঁদের প্রভাব ও সম্পদ প্রদর্শনের জন্য বড়ো আকারে পূজার আয়োজন করতেন। ১৬০৬ সালে নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষদের দ্বারা আয়োজিত পূজা এই ঐতিহ্যের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।



ব্রিটিশ যুগে দুর্গা পূজা

ব্রিটিশ শাসনামলে (১৮শ শতাব্দী) দুর্গা পূজা একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে নতুন মাত্রা পায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর নবকিষাণ দেবের বাড়িতে রবার্ট ক্লাইভের উপস্থিতিতে দুর্গা পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সময়ে কলকাতার বণিক শ্রেণি ও জমিদাররা পূজাকে একটি প্রদর্শনীমূলক উৎসব হিসেবে গড়ে তোলেন। শোভাবাজার রাজবাড়ি, সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার এবং অন্যান্য প্রভাবশালী পরিবারের পূজা বিখ্যাত হয়ে ওঠে।

১৯শ শতাব্দীতে দুর্গা পূজা ধীরে ধীরে জমিদারদের বাড়ি থেকে সর্বজনীন উৎসবে রূপান্তরিত হয়। ১৭৯০ সালে গুপ্তিপাড়ায় প্রথম সর্বজনীন দুর্গা পূজার আয়োজন করা হয়, যেখানে গ্রামের সকলে মিলে অর্থ সংগ্রহ করে পূজার আয়োজন করেছিল। এই প্রথা ধীরে ধীরে কলকাতা ও অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ে।



আধুনিক যুগে দুর্গা পূজা

২০শ শতাব্দীতে দুর্গা পূজা বাঙালির সর্বজনীন উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতার কুমারটুলির মূর্তি শিল্পীদের হাতে তৈরি মাটির মূর্তি এই উৎসবের একটি প্রধান আকর্ষণ। প্যান্ডেল সজ্জা, আলোকসজ্জা এবং থিম-ভিত্তিক পূজা আধুনিক দুর্গা পূজার বিশেষত্ব। ১৯২০-এর দশকে সর্বজনীন পূজার প্রসার বাড়ে, এবং ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর এই উৎসব আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে।

২০২১ সালে কলকাতার দুর্গা পূজা ইউনেস্কোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ তালিকায় স্থান পায়, যা এর বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব ও শৈল্পিক মূল্যকে তুলে ধরে। আজ দুর্গা পূজা শুধু বাংলায় নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিশ্বের বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে উদযাপিত হয়।




দুর্গা পূজার অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

দুর্গা পূজা কেবল ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, এটি একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর হাজার হাজার পূজার আয়োজন করা হয়, যা মূর্তি শিল্পী, প্যান্ডেল নির্মাতা, আলোকশিল্পী, এবং ব্যবসায়ীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দুর্গা পূজা পশ্চিমবঙ্গের জিডিপির ২.৫৮% অবদান রাখে এবং প্রায় তিন লক্ষ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।


উপসংহার

দুর্গা পূজার ইতিহাস পৌরাণিক কাহিনী, মধ্যযুগীয় ঐতিহ্য এবং আধুনিক সাংস্কৃতিক উৎসবের এক অপূর্ব মিশ্রণ। এটি বাঙালির জীবনে একটি আবেগময় সেতু, যা ধর্ম, শিল্প, এবং সম্প্রদায়ের একতাকে একসঙ্গে বেঁধে রাখে। প্রতি বছর মা দুর্গার আগমন বাঙালির হৃদয়ে নতুন আশা ও উৎসাহ জাগায়, এবং বিসর্জনের সময় “আসছে বছর আবার হবে” বলে আমরা তাঁর প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় থাকি।

শুভ দুর্গা পূজা!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Hi Today gk guide Viewer please, Do Not Spam In Comments

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)