১৭৯০ সালে গুপ্তিপাড়ায় প্রথম সর্বজনীন দুর্গা পূজার ইতিহাস
দু(caps)র্গা পূজা
বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উৎসবের ইতিহাসে ১৭৯০
সালে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় আয়োজিত প্রথম সর্বজনীন দুর্গা পূজা একটি
গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই পূজা বাংলার দুর্গা পূজার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের
সূচনা করে, যেখানে পূজা
জমিদারদের বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সর্বজনীন
রূপ লাভ করে। এই নিবন্ধে আমরা গুপ্তিপাড়ার প্রথম সর্বজনীন দুর্গা পূজার ইতিহাস,
এর পটভূমি এবং তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করব।
পটভূমি
১৮শ শতাব্দীর
বাংলায় দুর্গা পূজা মূলত জমিদার, রাজা-মহারাজা
এবং ধনী বণিক পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই পূজাগুলি ছিল ব্যয়বহুল এবং
প্রদর্শনীমূলক, যা সমাজের
সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ কমই দিত। তবে, ব্রিটিশ শাসনকালে (১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর) বাংলার অর্থনৈতিক ও
সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনের ফলে জমিদারি ব্যবস্থার
প্রভাব বাড়ে, এবং নতুন বণিক
শ্রেণির উত্থান ঘটে। এই সময়ে সমাজের মধ্যে একতার প্রয়োজনীয়তা এবং সাধারণ
মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এই পটভূমিতে গুপ্তিপাড়ায়
সর্বজনীন দুর্গা পূজার সূচনা হয়।
গুপ্তিপাড়ার
প্রথম সর্বজনীন দুর্গা পূজা
১৭৯০ সালে
হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় একদল বন্ধু মিলে প্রথম সর্বজনীন দুর্গা পূজার আয়োজন
করে। ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে, এই
পূজা ‘বারো-য়ারি’ পূজা নামে পরিচিত ছিল। ‘বারো-য়ারি’ শব্দটির অর্থ ‘বারো বন্ধু’
বা ‘বারো জনের অংশগ্রহণ’, যা
ইঙ্গিত করে যে এই পূজা ১২ জন বন্ধুর সম্মিলিত উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল। এই বন্ধুরা
গ্রামের বিভিন্ন পরিবার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এবং সম্প্রদায়ের সকলের অংশগ্রহণে
পূজার আয়োজন করেন।
এই পূজার
বিশেষত্ব ছিল এর সর্বজনীন চরিত্র। জমিদারদের বাড়ির পূজার বিপরীতে, গুপ্তিপাড়ার এই পূজায় গ্রামের সকল শ্রেণির
মানুষ অংশ নিতে পারত। এটি ছিল একটি গণতান্ত্রিক উদ্যোগ, যেখানে ধনী-গরিব, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ
নির্বিশেষে সকলেই পূজার অংশ হয়েছিল। এই উদ্যোগ সমাজে একতা ও সম্প্রীতির বার্তা
ছড়িয়ে দেয়।
ঐতিহাসিক
তাৎপর্য
গুপ্তিপাড়ার
বারো-য়ারি পূজা দুর্গা পূজার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি প্রথমবারের মতো
দুর্গা পূজাকে ব্যক্তিগত বা অভিজাত শ্রেণির সীমানা থেকে বের করে সাধারণ মানুষের
উৎসবে রূপান্তরিত করে। এই পূজা পরবর্তীকালে কলকাতা ও বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে
সর্বজনীন পূজার প্রচলনের পথ প্রশস্ত করে।
১৮৩২ সালে
কোসিমবাজারের রাজা হরিনাথ এই বারো-য়ারি পূজার ধারণাকে কলকাতায় নিয়ে আসেন,
যা পরে কলকাতার সর্বজনীন পূজার ভিত্তি তৈরি করে।
১৯১০ সালে বাগবাজারে সনাতন ধর্মোত্সাহিনী সভা সম্পূর্ণ সর্বজনীন পূজার আয়োজন করে,
যা গুপ্তিপাড়ার পূজার ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা
যায়।
সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক প্রভাব
গুপ্তিপাড়ার
সর্বজনীন পূজা শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি
ছিল একটি সামাজিক আন্দোলন। এই পূজার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ একত্রিত
হয়ে একটি সাধারণ উদ্দেশ্যে কাজ করেছিল। এটি সামাজিক সমতা ও সম্প্রদায়ের ঐক্যের
একটি উদাহরণ স্থাপন করে। পূজার আয়োজনের জন্য অর্থ সংগ্রহ, প্যান্ডেল নির্মাণ, এবং
অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
এই পূজা বাংলার
সাংস্কৃতিক জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূজার সময় স্থানীয় শিল্পী,
কারিগর এবং সঙ্গীতজ্ঞরা তাঁদের প্রতিভা
প্রদর্শনের সুযোগ পেতেন। এটি স্থানীয় অর্থনীতিকেও উৎসাহিত করত।
উপসংহার
১৭৯০ সালে
গুপ্তিপাড়ায় প্রথম সর্বজনীন দুর্গা পূজা বাঙালির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে
একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই পূজা দুর্গা পূজাকে জমিদারদের বাড়ির বাইরে নিয়ে এসে
সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। গুপ্তিপাড়ার এই উদ্যোগ আজকের
বিশাল সর্বজনীন দুর্গা পূজার ভিত্তি স্থাপন করে, যা কলকাতা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঐতিহ্য
আজও বাঙালির হৃদয়ে জাগ্রত, এবং
প্রতি বছর মা দুর্গার আগমনে আমরা এই সাংস্কৃতিক ঐক্যের উদযাপন করি।
শুভ দুর্গা
পূজা!


Hi Today gk guide Viewer please, Do Not Spam In Comments